বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত
[তৃতীয় পর্ব]
এটা আমি নই যে তোমাকে ছুঁলো। এটা আলো।
রিফিউজিক্যাম্প
বিহীন আলো।
—ভোর
চারটের কবিতা, শারন হাস্
প্রযোজকের ফিরিস্তি
পাঠক, আপনার সঙ্গে
আমার প্রায় ২৮৮৮ শব্দ পরে আবার কথা হচ্ছে। এরপরে আবার কখনও কথা বলার সুযোগ হবে
কিনা জানি না। আমি শুধু একটিই কথা আপনার জন্য বলে যেতে চাইছি, সেটি হ’ল, একটি
বল্লম কল্পনা করুন। বল্লম ভাবতেই শুরুতে তার তীক্ষ্ণ ও ছুচলো ফলাটি যদি আপনার মনে
এসে থাকে, তবে মনকে বলুন, ‘না’। একটি দীর্ঘ, চকচকে, ভারী, মোটা, আবলুশ, বলান্বিত, পূর্ণ
ভল্ল বা শূল বা বর্শা কল্পনা করুন। পূর্ণ দৈর্ঘ্যে তাকে দেখুন। দীর্ঘ এই বল্লমটি ১৯টি
বা ২৮টি বা ১০৮টি ভাগে বিভক্ত—এইরূপ কল্পনা করতে পারেন। এখন তার হাতলের
দিকটি আপনি ধরে আছেন। এই মুহূর্তে বল্লমের যেখানে আপনার হাত, সেটি বল্লমের তৃতীয়
ধাপ। বাকি ধাপগুলিও আপনাকে এভাবেই ভারী ও দীর্ঘ বল্লমটিকে
নিয়ে চলতে হবে। বল্লমটি উল্লম্বভাবে ভূমিতে গাঁথা। অর্থাৎ ফলার দিকটি মাটিতে।
প্রতিটি ভাগে হাত রেখে ধাপে-ধাপে আপনাকে ফলা অবধি নামতে হবে। একটি ভাগ একবার চলে
গেলে, জীবনের মতো, সময়ের মতোই সে-ভাগ আর কোনওভাবেই ফিরে আসবে না। বোঝাতে পারলাম
কি? অর্থাৎ, আপনি এখন এই বল্লমের তৃতীয় ভাগে হাত রেখেছেন। পরিশিষ্ট ভাগের কোনও
অংশেই এর পূর্ব কোনও অংশের কাহিনি-ঘটনা-বর্ণনা-উল্লেখ-স্মৃতি-উক্তি-উদ্ধৃতি-রেফারেন্স-উপাখ্যান-ইতিবৃত্ত-আখ্যান-উপাত্ত-উপপাদ্য-সম্পাদ্য-এক্সট্রা-টীকা
কিছুই বস্তুগতভাবে ফিরে আসবে না। আপনি চাইলেও ফিরতে পারবেন না। জীবন, সময় কেউ
আপনাকে ফিরতে দেবে না। পেছনে ফেরার নিয়ম নেই। শুধু আপনি একটি এবং অনেক অখণ্ড
স্মৃতি ও সভ্যতাকে নিজের ভেতরে ধারণ ক’রে চলবেন। দিস ইজ দ্য ল বিয়ন্ড অল ল, দ্যাট
ক্যান ওন্লি বি পজিটেড অ্যাজ আ ফাইনাল স্ট্রাকচার, অ্যাজ আ ভ্যানিশিং পয়েন্ট অফ
এনি রিয়েলিটি। ঋজু এবং একমাত্র ঋজুভাবেই ইহা নিজ ফলা অভিমুখে যাত্রা করিবে, এবং
তার স্বীয় লক্ষ্যে আপতন বিন্দুতে নিজেকে বিদ্ধ করিবে। আপনি তার নখদন্তহীন পাঠক, দর্শক,
বাহক, খোচড়, সঙ্গী কিংবা সহযোদ্ধা—কী হবেন, পছন্দ আপনার।
আমার কাজ এখানেই শেষ, আপাতত। উপন্যাসটি যদি আবার সুযোগ দেয়,
আসব। যেহেতু আমার ফিরে আসাটি অনিশ্চিত, তাই এখানে একপ্রস্থ বিদায় জানিয়ে রাখলাম।
আমি এই উপন্যাসের কেউ নই। কোনও চরিত্রও নই। লেখক তো নই-ই। আমাকে বরঞ্চ এর প্রযোজক
বলতে পারেন। উপন্যাসের চরিত্রেরা প্রত্যেকেই সচেতন এবং দক্ষ। উপন্যাসে তাদের
নিজস্ব জীবন ও পরিসর রয়েছে। বাইরে থেকে কোনও হাম্বরা নিয়ন্ত্রক বা গেছো পরিচালকের
প্রয়োজন এঁদের হয়নি। হবে না। এঁরা নিজেরা যেটা ভালো মনে করেছেন, সেটাই করেছেন। এবং
বলেছেন। আমার এঁদেরকে কিছুই বলার ছিলনা—‘আপনারা একত্রিত হউন’—এটুকু ছাড়া।
জীবদ্দশায় নিজেদের জীবন ও সাহিত্যে এঁরা যে সুড়ঙ্গ কেটে রাজপথ নির্মাণ করেছেন,
তারপর এঁদের জিভে ডায়লগ বসাবার ধৃষ্টতা আমার ছিল না। নেইও। সর্বোপরি, উপন্যাস একটি
লিভিং অবজেক্ট। যেকোনও জীবিত প্রাণবস্তুর মতো সেও নিজে নিজের প্রয়োজনীয়
সঞ্চালনটুকু সক্ষম করিতে পারঙ্গম। আমি শুধু একটি বল্লম কুড়িয়ে পেয়েছিলুম
ভারতবর্ষীয় এক পরিত্যক্ত ইঁদারায়। সেটিই রইল আপনার জন্য। এবার তাকে কল্পনা করুন। আপনি।
পুনশ্চঃ সন্দীপন
এসেছিলেন একটু আগে। মানে, চট্টোপাধ্যায়। আমার কাছে। এই উপন্যাসে তিনিও একজন। সেটা
নিয়েই, বিশেষত চরিত্র, অভিনয়, তাদের ভাষা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে। যাবার সময় একটা
চিরকুট ধরিয়ে গেলেন আমার হাতে। এখন সেটা খুলে দেখছি, ২৭শে এপ্রিল ১৯৯২ তারিখে লেখা
ওঁর ডায়রির একটা অংশ। লেখা—‘শিল্পী কখনও ক্যালেন্ডারের পথ ধরে চলেন না। যে পথ তাকে
আলো দেখায় তিনি চলেন সেই পথে’।
যদিও প্রেক্ষাগৃহে টিকিট কেটে বা না-কেটে আসা দর্শক শুধু
মঞ্চস্থ নাটকটিই দেখেন, মহড়া কক্ষে বা গ্রিনরুমে পরিচালক/প্রযোজকের সাথে
কলা-কুশলিদের সংলাপ তাদের জানার কথা নয়। তবু এটা জানালাম। মনে হল, কাজে আসতে পারে।
আপনার।
রেখো মা দাসেরে মনে
পরদিন সকালে
একটা রিকশা এসে থামে কোচবিহার রাজবাড়ির সামনে। রিকশায় দু’জন। অরুণেশ আর
বঙ্কিমচন্দ্র। অরুণেশের সাথে শেষবার হাত মিলিয়ে বঙ্কিম ভেতরে ঢুকে যান। সামনে প্রধান ফটক। ফটকের বাম ও ডান পাশের দুই স্তম্ভের শীর্ষে
দণ্ডায়মান সিংহ ও গজ মূর্তি। সিংহদরজাটি বন্ধ। তার পাশে ছোট একটি সাধারণ গেট করা হয়েছে। পর্যটকদের ঢোকার
জন্য। সেখান দিয়েই ঢোকেন বঙ্কিম। কোচবিহারের এস ডি ও এবং ডি এম-কে ব’লে
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকা রাজবাড়ির দস্তাবেজখানায়
ঢোকার ব্যবস্থা করেছেন বঙ্কিম। এছাড়াও দস্তাবেজখানার দায়িত্বে থাকা মিহিরচন্দ্র
বর্মণকে ব’লে রেখেছেন অরুণেশ। মূল ফটক থেকে ভেতরে প্রায় এক শ মিটার হেঁটে রাজবাড়ি। বাঁ পাশে ঝিল। ঝিলে একটা পানকৌড়ি
অনেকক্ষণ মুখ তুলে দ্যাখে বঙ্কিমকে। দু’ পাশে সমান ও মসৃণ ক’রে ছাঁটা ঘাসের
গালিচা, নরম সবুজ। ফুল গাছ। পাতাবাহার, কেয়ারি করা। বাগান। পানকৌড়িটির কাছ থেকেই বঙ্কিম
জানতে পারেন উলটোদিকেই একটু হেঁটে গেলে অমিয়ভূষণের বাড়ি। ১৮৬০ সালে এই রাজবাড়িতেই
এসেছিল মধুসূদন দত্ত’র চিঠি। তখনও অবশ্য নির্মাণ হয়নি এই প্রাসাদ। তখন পানকৌড়িটি
ছিল রাজবাড়ির অন্যতম দ্বাররক্ষী। এ’ জন্মে সে পানকৌড়ি হয়েছে। কে গেল কে এল সেদিকে
তার এখনও দারুণ খেয়াল। আজ, দেড় শ বছর পর বঙ্কিমচন্দ্র এসেছেন মাইকেলের সেই চিঠি ফেরৎ নিতে। এমত দৃশ্য দেখিয়াছ
আরু এমত প্রেম এমত খেলা। মধু সাধু খাঁ-র বিখ্যাত লাইন। বঙ্কিমের মনে আসে।
পানকৌড়িটি অমিয়ভূষণের কথা বলার পর থেকেই এই লাইন ফিরে ফিরে ঘুরে যাচ্ছে তাঁর মনে।
এইসব ভাবতে ভাবতে এসে পড়েন রাজবাড়ির সদর দরজার সামনে। শীতের মেঘ ভাঙা রোদ পড়েছে
গম্বুজে। রূপোলি গম্বুজের একদিক তাতে চকচক করছে। ভেতরে ঢুকে রাজবাড়ির মাঝখানে
দরবার কক্ষে চলে আসেন বঙ্কিম। কক্ষটি
গোলাকার। তার ওপর সুউচ্চ ধাতব গম্বুজ। ডান দিক দিয়ে কাঠের চওড়া সিঁড়ি। উঠতে থাকেন। দোতলায় এসে
বারান্দা ধ’রে হাঁটেন। গ্রন্থাগার।
অতিথিশালা। ভোজনকক্ষ। বৈঠকখানা। স্নানঘর। একটা ঘরে একাদশ-দ্বাদশ শতকের পাথরের মূর্তি। কোনও ঘরে রাজার বিলিয়ার্ড বোর্ড। বাঙলা হরফ খোদাই করা
নারায়ণী মুদ্রা। তৈলচিত্র। পশুর চামড়া,
শিং, নখ—শিকারের চিহ্ন। রূপোর
চাবি। চামচ। তালা। হেঁটে হেঁটে দস্তাবেজখানার সামনে এসে থামেন। দরজার বাইরে
মিহিরচন্দ্র অপেক্ষা করছিলেন বঙ্কিমের জন্যেই। সাধারণের জন্য এই ঘর খোলা হয় না।
বিশেষ অনুমতি নিয়ে এলে তবেই ঢোকা যায়। মেঝে থেকে
সিলিং অবধি খোপ খোপ করা উঁচু উঁচু কাঠের র্যাক। তাতে ঠাসা লক্ষ লক্ষ কাগজ। পুঁথি।
বই। ফাইল। দলিল। পর্চা।
ম্যাপ। খতিয়ান।
চিঠি। তালপত্র আর প্রাচীন দেশী হ্যান্ড-মেড
পেপারে ভরা এই ঘরের গন্ধটাই
বাইরের জগৎ থেকে আলাদা। কত কত-শ বছরের কত কথাবার্তা দিয়ে ঠাসা এই ঘর।
সময় সরণির বাইরে দাঁড়িয়ে তারা যেন এখনও কথা বলে চলেছে নিজেরা। কত চিঠি চালাচালি।
কত যুদ্ধের ফরমান। কত সন্ধিপত্র। কত অধিগ্রহণ। কত ভাগ বাঁটোয়ারা। কত
চুক্তিপত্র। কত হস্তান্তর। কত পাট্টাপত্র, ইজারাপত্র, সনন্দপত্র, পত্তনিপত্র,
ভাষপত্র, তমসুকপত্র, বন্দোবস্তপত্র, দখলিপত্র, রসিদপত্র। কত দাসখৎ, এজাহারানামা,
হুকুমনামা, বন্ধকনামা, সালিশনামা, জামিননামা, তালাকনামা, হলফনামা।
মিহিরচন্দ্র বলছিলেন, শুধু মধুসূদনের
চিঠিই নয়, আরও কত যে ঐতিহাসিক চিঠি দলিল নথি
রয়েছে এখানে,
যা বাঙলা সাহিত্যের অমর সম্পদ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চিঠি। কেশবচন্দ্র সেনের চিঠি।
তাঁর মেয়ে সুনীতি দেবীর সাথে কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিয়ের আমন্ত্রণ
পত্র। সুনীতি দেবীরা ছিলেন ব্রাহ্ম। আর কোচবিহার রাজপরিবার হিন্দু। এই বিয়েতে
দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল খুব। ইংরেজকেও হস্তক্ষেপ করতে হয় এই বিয়েতে। সেইজন্য অনেক
চিঠি আদান প্রদান হয়েছিল। সব রাখা আছে এই ঘরে।
রাজা মল্লদেব, যিনি নরনারায়ণ নাম নিয়ে
সিংহাসনে বসেন, ষোড়শ শতকের পাঁচের দশকে, ১৪৭৭
শকাব্দে, অর্থাৎ ১৫৫৫-’৫৬ নাগাদ, তিনি একটি চিঠি লেখেন অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণ চুখাম ফা-কে (সুখাম্পা?)। কেঁচোর রসে
লেখা হয়েছিল এই চিঠি। খুব সম্ভব,
এটাই এখনও অবধি
পাওয়া প্রথম ও সর্বাধিক প্রাচীন বাঙলা লিখিত গদ্যের একমাত্র প্রামাণ্য নথি। তখন
কোথায় ইংরেজ। কোথায় ওলন্দাজ। কোথায় পর্তুগীজ। অথচ তখনই নিজের খেয়ালে গড়ে উঠছে
বাঙলা গদ্যের রূপ। মিশনারিদের হাতে নয়।
এদেশেরই মানুষের হাতে। এমনকি
রামমোহন বিদ্যাসাগরেরও অনেক আগে। ইংরেজি গদ্য থেকেই অনেক কিছু নিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী
থেকে বর্তমান কালের বাঙলা গদ্য তার গঠন ও পরিণতি পেয়েছে। মজবুত
বাঙলা গদ্যের বুনিয়াদ উনিশ শতকেরই অবদান। কিন্তু তারও
আড়াইশো বছর আগে, ইংরেজরা আসার
আগে এবং ইংরেজি সাহিত্যের সাথে পরিচয়ের আগেও যে এ’ দেশে এ’ ভাষায় নিজস্ব গদ্য ছিল,
তার প্রমাণ এই চিঠি। ইউরোপীয় মিশনারিদের হাতেই বাঙলা গদ্যের জন্ম হয়েছে, আমাদের
দেশের গেঁড়ে ঢ্যামনা ইতিহাসবেত্তাদের এই পেদো গন্ধপাতাযুক্ত তত্ত্বনামাটি যে
কতখানি ঐতিহাসিক খিল্লি তার প্রমাণ ব্রিটিশ-পূর্ব যুগের এই চিঠিপত্রগুলি। সেইসময়ে অসম,
কাছাড়, মণিপুর, ভুটান ও কোচবিহারের রাজারা পরস্পরকে চিঠি লিখতেন অসমীয়া, কামতাপুরী, সংস্কৃত, বাঙলা ও ফারসি
মিশ্রিত এই
ভাষাতেই। স্থলপদ্মের মতো গম্ভীর, স্মিত
সালঙ্কারা সৌকর্যের এই চিঠির ভাষার কাছে নতজানু হয়ে ব’সে থাকেন বঙ্কিম।
তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্চা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি
গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে
বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক।
এই ভাষা স্থাপত্য তো একদিনে গড়ে
ওঠেনি। এমন তো আর নয় যে মহারাজা নরনারায়ণ এক সকালে উঠে এই চিঠি লিখে ফেললেন। এ’ এক
আবহমান, চলিষ্ণু স্রোত। বিরাট এক ভূ-খণ্ডে যে স্রোত একদা তার নাব্যতা খুঁজে
নিয়েছিল। নরনারায়ণ সেই ধারারই এক প্রামাণ্য ঢেউ। কত না দিক থেকে বাঙলা ভাষা তখন জোয়ারের জল ছেঁচে তুলে
আনছে নতুন-নতুন সম্পদ তার ভাঁড়ারে। শুধু কি কামতাপুর? দক্ষিণ-রাঢ়ভূমির সুফি খাঁ,
ইসমাইল গাজি, শাহ্ গরিবুল্লাহ্, হাজি মোহাম্মদ, শেখ চান্দ, ফকির মহাম্মদ—এঁদের
নিয়ে গ’ড়ে উঠছে পীর সংস্কৃতি। বখতিয়ার খলজির বাঙলাদেশ জয়ের পর সহজিয়া আর সুফির
সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব বাঙলাভাষার সৃষ্টি হচ্ছে তখন। এরও পরে মুর্শিদাবাদ হ’ল
বাঙলার রাজধানী। মুসলমান তুর্কিরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা তুর্কিতে চালালেও
রাজ-দরবার তো চলত ফারসিতে আর ধর্মাচরণ আরবিতে। ভাষা তার গতি নিল এইখানে। দরবারের
লোকেদের সাথে বাঙলার সাধারণ মানুষের যত ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে ততই বাঙলায় মিশে যাচ্ছে
আরবি ফারসি। তৈরি হচ্ছে মিশ্ররীতির এক ভাষ্য। ভেতর থেকে শাবলের চাড় দিয়ে উঠে মাটির
উপরিতলের শিলাস্তর ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছিল ভাষার এক নিজের গতি। অথচ পরবর্তী পর্যায়ে প্রতীচীর দুর্বার স্রোত যখন এল, এক সপাট
ব্রাশ স্ট্রোকে ক্যানভাসের নিজস্ব রঙ গেল আড়াল হয়ে। একটি ভাষার নিজের গড়ে তোলা
প্রীতির সেই অঙ্কুরিত বীজ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল সেদিন। আজ, এ’ ভাষার রঙ দেখলে সেদিনের
কিছুমাত্র প্রত্যভিজ্ঞান হয় কি?
এরকম জায়গায় এলে প্রয়োজনের কথা মনে থাকে
না। চোখের পাতা নরম হয়ে আসে। পা ধীর হয়ে যায়। সময় যে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলছে
না; তা যে বিচিত্র ও বহুগামী, তার যাত্রাপথ কখনোই হরাইজেন্টালি নয়, সরলরৈখিক তো
নয়ই, বরং সে ছড়িয়ে আছে নানান দিকে, নানান ভাবে। বিরাটাকায় এক ফোঁড়ার মতো তার
বহুমুখ। রাবণের মতো তার দশ মাথা। কুড়ি চোখ। এই
বোধ জন্ম নেয় এরকম জায়গায় এলে। বঙ্কিমচন্দ্রও এই ভাবনার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর
মনে প্রশ্ন আসে, মানুষ ইতিহাস সংগ্রহ করে কেন? কেন সে অনুসন্ধানে নামে? পায়ে চলার
দাগকে কেন সে ফিরে এসে আবার পায়ে গলিয়ে দেখতে চায়? শুধু নিজের ইতিহাস নয়,
সম্প্রদায়ের ইতিহাস, গোষ্ঠীর ইতিহাস, সমাজের ইতিহাস, দেশের ও বিশ্বের ইতিহাস,
প্রজাতির ইতিহাস, সমগ্র জীবকুল, প্রাণি ও উদ্ভিদ জগতের ইতিহাস, গোটা ব্রহ্মাণ্ডের
ইতিহাস সে জানতে চায়।
কেন? কী তার
খোঁজ? কী জানতে চায় সে? খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে কী দেখতে চায় মানুষ? কেন তার
এই অভীপ্সা জাগে? সে কি বিশ্বাস করে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড এবং গোটা জড় ও জীবজগতের অণু
পরমাণু কণা নিয়ে নিয়ে সে নিজে নির্মিত, না-কি এই সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে আছে তার নিজের
চেতনকণা? না-কি চেতনার এই অন্তর্মুখী অথবা বহির্মুখী কিংবা উভয়মুখী গতায়াতেরও
ঊর্ধে গিয়ে আরও কিছু সে জানতে চায়? কী রহস্য সমাধানে নেমেছ তুমি, হে শার্লক-রূপী
মানুষ? আবার ইতিহাস সে গোপনও করে। ধ্বংসও করে। বিকৃত করে। অতিরঞ্জিত করে। মানুষেরই
মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে তা পালটে যায়। কতটা ভয় পায় মানুষ তাকে? কতটা ভালোবাসে? কতটা
তার আত্মরমণ? কতটা আত্ম-উদ্বোধন? কতটা সে পর্দা টানে? কতটা ফাঁক করে?
হরিদাস মণ্ডল নামে এক মেচ দলপতির সাথে
হাজো নামের এক কোচ ভুঁইঞার জীরা এবং হীরা নামের দুই মেয়ের বিয়ে হয়। জীরার গর্ভে চন্দন ও মদন এবং হীরার গর্ভে শিশু ও বিশু
জন্মায়। চন্দন হন কোচ-রাজবংশের প্রথম রাজা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিম থেকে
করতোয়া অবধি, সঙ্কোষ নদীর পশ্চিমে করতোয়া থেকে বড়নদী পর্যন্ত সমগ্র ভূ-খণ্ড
কামতা-কোচবিহার নামে ষোড়শ শতকে একটি সার্বভৌম রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৬০
সালে এই রাজ্যেরই প্রশাসনিক প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট পদের জন্য
ইংলিশম্যান পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। মধুসূদন দত্ত তখন চাকরি করেন কলকাতা
পুলিশ কোর্টে। অর্থাভাবে জর্জরিত মধুসূদন এই বিজ্ঞাপন
দেখে চাকরির জন্য আবেদন পত্র পাঠান কোচবিহারের তদানীন্তন মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের
কাছে। এতদিনে সময়ের ধুলো লেগে লাল হয়ে যাওয়া মধুসূদনের চিঠিটি হাতে নিয়ে মেঝেতে
ব’সে পড়েন বঙ্কিমচন্দ্র।
একবার, দু’বার,
তিনবার, বারবার পড়তে থাকেন। সজোরে। উচ্চারণ ক’রে। যেন এই ঘরে গাদাগাদি হয়ে থাকা
ধুলো কাগজের ইতিহাসকেই তিনি একটুকরো ইতিহাস শোনাচ্ছেন। খুব ইচ্ছে হয়, এখনই
মধুসূদনের কাছে গিয়ে বলেন, মাইকেল, তোমার না-পাওয়া চাকরির হারিয়ে যাওয়া চিঠি আমি
পেয়েছি মাইকেল। পকেট থেকে শাদা কাগজ বের ক’রে টুকে নেন চিঠিটি।
Calcutta Police
27th January, 1860
My dear Raja Saheb,
I see an advertisement in the ‘Englishman’ in which
your Highness wants a Magistrate. Allow me to offer my service to you. Your
Highness knows that I have been for several years connected with the Calcutta
Police and undersigned criminal matters pretty well. If the salary be worth
accepting that is to say, if be it worthy of a Prince like your Highness to
offer and a gentleman like myself to accept, pray, write to me and I shall go
up. Your Highness must know that I shall have to sacrifice my prospects here if
I go up to your country and the offer must be tempting enough to induce me to
do so. I shall undertake to give you such a Police Establishment through your
principality in one year that your Highness will win praise of the British
Govt. your Princely word that I am not turned out at a moment’s notice to
gratify the hatred of some unprincipled Court-intrigues. Your Highness no doubt
knows that such an important post must not be given to any but a gentleman of
education and principle of will accept such a solution but on very liberal
terms.
With kind wishes.
Your Highness’s very sincerely
Michael M. S. Dutt
Michael M. S. Dutt
27th January, 60
A Candidate for the vacant Magistracy.
বঙ্কিমচন্দ্র উঠে আসেন দস্তাবেজখানা থেকে। মনটা ভারী হয়ে আছে। কী যেন হারিয়ে ফেললেন। কী যেন খুঁজে পাওয়া গেল না মনে হয়। আবার ভালোও লাগে। ধরা-অধরার ছায়া নিয়ে ধীরে ধীরে নামেন সিঁড়ি ভেঙে। মিহিরচন্দ্র পেছন থেকে ডাকেন। ‘চা খাবেন না বাবু?’ বঙ্কিম
কিছু বলেন না। হাত নেড়ে না বলেন নামতে
নামতে।
(চলবে)
0 comments:
Post a Comment